পাথৈর ইসলামীয়া দাখিল মাদরাসা বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত


চাঁদপুর জেলার শাহারাস্তি উপজেলার বহু আলোচিত একটি দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জল্পনা কল্পনার গল্পের মাঝে আমরা যেন হাবুডুবু খাচ্ছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭২ সালের পহেলা জানুয়ারি এই প্রতিষ্ঠানটির জন্ম।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর শেষে যেন প্রতিষ্ঠানটি তার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে অভিশাপ দিচ্ছে শিক্ষা সংশ্লিষ্টদেরকে!
১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার চিতোষী পশ্চিম ইউনিয়নের (তৎকালীন হাজীগঞ্জ থানার এবং কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত) পাথৈর গ্রামের মাঝামাঝি উপজেলার মধ্য দিয়ে বহমান একমাত্র নদী ডাকাতিয়ার দক্ষিণ পাড়ের ৩০০ গজের মধ্যে ৩ একর ৭২ শতক জায়গায় স্থাপিত হয় ‘পাথৈর ইসলামীয়া দাখিল মাদরাসা’।
এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা হিসেবে তৎকালীন সময়ে অনেকের মধ্যে অন্যতম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মাওলানা আলী আকবর এবং প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নির্বাহ করেন মাওলানা এমদাদুল হক।
এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এলাকায় একটি মহল উক্ত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির জায়গা নিজেদের দখলে নিতে উঠে পড়ে লাগেন। তৎকালীন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় উদ্যোক্তাগন প্রতিষ্ঠানটি ভালোভাবে পরিচালনায় মাদ্রাসার পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন। শুরু থেকে তাদের শক্ত অবস্থানের কারণে কায়েমী স্বার্থবাদীদের অভিলাষ ভেস্তে যায়। দীর্ঘ বছর নিম্ন আদালত ও উচ্চ আদালতে মামলা চলে। শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালত থেকে মাদ্রাসার পক্ষে রায় আসে। বলা যায় একের পর এক মামলার ঘানি টানতে টানতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির পাঠদানে আশাতীত সাফল্যে বিঘ্ন ঘটে।
মাদ্রাসার বর্তমান সুপার মোঃ আব্দুর রহিম বলেন, ১৯৭২ সালে গোড়ার দিকে অত্র এলাকার কতিপয় শিক্ষানুরাগী বিদগ্ধ ব্যক্তিবর্গ এলাকার ছেলে-মেয়েদের শিক্ষাগ্রহনের সুবিধার্থে পাথৈর ইসলামীয়া দাখিল মাদরাসাটি স্থাপন করেন। শুরুতেই মাদ্রাসাটির জায়গার উপর কুনজর পড়ে একটি কুচক্রী মহলের। তারা প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বহু ষড়যন্ত্র করেন। তারা মাদ্রাসাটির জায়গার মালিকানা দাবি করে একের পর এক মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন মামলা দায়ের করেন। বহু বছর মামলাগুলো কঠোর হস্তে মোকাবিলা করেন এলাকার বিদুৎসাহী বিশিষ্ট জনেরা। শেষ পর্যন্ত সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে নিম্ন আদালত ও হাইকোর্ট মাদ্রাসার পক্ষে রায় দেন ২০২৫ সালের গোড়ার দিকে। এসময়ে মামলা মোকদ্দমার পিছনে সময় দিতে গিয়ে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় প্রভাব পড়ে। যার ফলে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনে অনেকটাই ব্যর্থ হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এসময় অত্র প্রতিষ্ঠানের নামে নতুন ভবন নির্মাণে অর্থ মঞ্জুর হলেও মিথ্যা মামলা মোকদ্দমা থাকায় মঞ্জুর হওয়া অর্থ ভবন নির্মাণ না করে ফেরৎ যায়। তবে এখন আর মাদ্রাসার বিরুদ্ধে কোন মামলা মোকদ্দমা নেই। এখন সময় এসেছে শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার।
মাদ্রাসাটিতে বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩১৫ জন। কর্মরত শিক্ষকের সংখ্যা ১১ জন আর শিক্ষকের শূন্য পদের সংখ্যা ৯টি, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর সংখ্যা ৫ জন।
অত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠাকালে এলাকার জনসংখ্যা ছিল অনেক কম। ঐ সময় মাদ্রাসাটির মাঠের মাঝামাঝি দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে মাদ্রাসার সীমানা ঘেঁষে উত্তর পাশে নির্ধারিত রাস্তা থাকা সত্ত্বেও মাঝমাঠ দিয়ে এলাকার মানুষ যাতায়াত করতো। সময়ের ব্যবধানে দীর্ঘ ৫৩ বছর শেষে আজ এলাকার জনসংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে। এখনও এই প্রতিষ্ঠানটির মাঝখান দিয়ে এলাকার মানুষ পূর্বের ন্যায় যাতায়াত করে। যার ফলে শ্রেণিকক্ষের স্বাভাবিক পাঠদান ও শিক্ষার্থীদের খেলাধুলায় অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। তাই মাদ্রাসার উত্তর পাশ দিয়ে যাতায়াতের রাস্তাটি এলাকার মানুষের চলাচলের জন্য সংস্কার করা সহ অনতিবিলম্বে মাদ্রাসার বাউন্ডারি ওয়ালটি নির্মাণ করা জরুরি প্রয়োজন।
এই মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠার পর মাদ্রাসা ক্যাম্পাসের উত্তর প্রান্তে শ্রেণি কক্ষ হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রথমে ২টি টিনের ঘরের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠদান কার্যক্রম শুরু হয়। মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে ২টি ছোট পুরানো টিনের ঘরে শিশুদের পাঠদান কার্যক্রম চলছে।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় পুরোনো টিনের শ্রেণিকক্ষে বৃষ্টির পানি পড়ে শিক্ষার্থীদের বই-খাতা ভিজে সয়লাব।
মাদ্রাসার সুপার জানান, শ্রেণিকক্ষের উপরের টিনের চালা অপেক্ষাকৃত অনেক নীচু হওয়ায় গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড রোদের তাপে পাঠদান কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থায় পড়তে হয়। এদিকে ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে মাদ্রাসার নামে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর চাঁদপুর থেকে একটি টিনশেড ভবন নির্মাণের জন্য ১৯ লাখ টাকার বরাদ্দ পাওয়া যায়।
উক্ত বরাদ্দে একটি টিনশেড ভবনের নির্মাণ কাজ শেষে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষকে ৫৩.৬২”×২৬” সাইজের ভবন হস্তান্তর করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিল উত্তোলন করে চলে যায়।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অফিস বা শ্রেণিকক্ষের যে পরিমাণ প্রশস্ত বারান্দা হওয়া প্রয়োজন নব-নির্মিত উক্ত টিনশেড ভবনে সেটি বিবেচনায় নেয়া হয়নি যা দেখতে অনেক দৃষ্টিকটু।
তাছাড়া উক্ত টিনশেড ভবনের পূর্ব অংশে দুইটি টয়লেট আকৃতির কিছু একটা নির্মাণের কাজ শুরু করে শেষ না করেই হস্তান্তর করা হয়েছে। এ বিষয়ে শাহরাস্তি উপজেলার দায়িত্ব প্রাপ্ত শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর চাঁদপুরের সহকারী প্রকৌশলী রাকিবের মোবাইল ফোনে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জানান, সাময়িক একটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে বারান্দা, এর চেয়ে বেশি প্রশস্ত রাখার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া এই ভবন নির্মাণের ডিজাইন প্রধান কার্যালয় থেকে করা হয়েছে। জানতে চাইলাম সরকারের ১৯ লাখ টাকা বরাদ্দে সাময়িক ভবন নির্মাণ করা হবে কেন? এই প্রশ্নের তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।
বর্তমানে এই দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিচালনা পরিষদ রয়েছে বলে অধ্যক্ষ জানান। মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মোঃ আবদুল মতিন।
সরজমিনে গিয়ে সাক্ষাৎ মিলে কমিটির বিদ্যুৎসাহী সদস্য মোঃ হাবিব এর সাথে। তিনি অত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও বর্তমানে বিরাজমান সমস্যাসমূহ তুলে ধরে বলেন, শুরু থেকে মাদ্রাসাটির নিজস্ব জায়গা ৭৪ শতাংশ জায়গার উপর একটি জলাশয় রয়েছে। উক্ত জলাশয়টিতে মাছ চাষ করলে যে আয় হতো তা যথাযথভাবে পাওয়া গেলে ঐ আয় দিয়ে মাদ্রাসার দৈনন্দিন খরচ অনায়াসে মিটানো সম্ভব ছিল।
তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, উক্ত জলাশয়ে বর্ষা মৌসুমে মাছ ছাড়লে জলাশয়ের পূর্ব ও দক্ষিণ পাড়ে বসবাসরত ব্যক্তিবর্গ অবাধে উক্ত জলাশয় থেকে মাছ ধরে নিয়ে যায়। এতে মাদ্রাসাটি আর্থিকভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া এই জলাশয়ের সাথেই আরও ৭৬ শতাংশ উঁচুনীচু জায়গা দক্ষিণ অংশে আছে যা এখনও কিছু মানুষ দখলে রেখে ভোগদখল করছে।
তিনি দ্বীনি এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠের মাঝখানে এলাকার মানুষের যাতায়াতের পথটি বন্ধ করে দিয়ে মাদ্রাসার উত্তর পাশের নির্ধারিত রাস্তাটি চলাচলের উপযোগী সংস্কার করে দেয়া, মাদ্রাসাটির বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ, ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ওয়াশ রুম নির্মাণ এবং ছাত্রীদের জন্য নামাজের ঘর নির্মাণের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের বিনীত আবেদন জানান।
তিনি এই মহতী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি শাহরাস্তি উপজেলা প্রশাসনের সহ চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের সদয় হস্তক্ষেপ কামনা করেন। সেই সাথে তিনি শাহরাস্তি উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাজিয়া হোসেনকে সরজমিনে মাদ্রাসাটি পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানান।
এলাকাবাসীর বক্তব্য, অত্র দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যাতায়াতের রাস্তাগুলো বৃষ্টি বাদলের সময় পানিতে ডুবে যাতায়াতের অনুপযোগী হয়ে যায়। যার ফলে বর্ষা মৌসুমে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াতে অনেক অসুবিধায় পড়তে হয়।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ফ্যাসিলিটিস ডিপার্টমেন্টের দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, এলজিইডি এবং শাহরাস্তি উপজেলা প্রশাসন সহ চাঁদপুর জেলা প্রশাসক তাদের সন্তানদের শিক্ষা গ্রহনের সুবিধার্থে অনতিবিলম্বে সমস্যাসমূহ সমাধানে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবেন বলে সকলে আশা করেন।
আপনার মতামত লিখুন