দক্ষিণ এশিয়ায় তরুণদের নেতৃত্বে আন্দোলনের জেরে কয়েক বছরের ব্যবধানে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালে সরকারের পতন হয়েছে। বিক্ষোভের ঢেউ লেগেছে আরও কয়েকটি দেশে। এসব আন্দোলনের মাধ্যমে তরুণরা শাসকগোষ্ঠীর অচলায়তন ভাঙার এক রীতি তৈরি করতে পেরেছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, রীতি ভাঙলেও এর মধ্যে দিয়ে দেশগুলোর রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতে তৈরি হয়েছে অস্থিরতা। আবার এ পরিস্থিতিকে ভবিষ্যৎ শক্তিশালী করার সুযোগ হিসেবেও দেখছেন তারা।
তরুণদের আন্দোলন ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ও চলতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে নেপালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন করেছে। এনেছে নতুন নেতৃত্ব। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, এসব আন্দোলন শুধু রাজনৈতিক দাবি নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা জনগণের অসন্তোষ-ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সাইমন মহসীন মনে করেন, তরুণদের অসন্তোষের প্রকাশ হিসেবে সংঘটিত আন্দোলনগুলো সংশ্লিষ্ট দেশে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
সাইমন বলেন, দুর্বল গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এমন আন্দোলন স্থিতিশীলতা আরও দুর্বল করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি অশান্তি দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা কমায় এবং সরকারের নজরদারি ও দমনমূলক পদক্ষেপ বাড়াতে পারে, যা তরুণদের আরও বিচ্ছিন্ন করবে।
এ গবেষকের দৃষ্টিতে সামাজিকভাবে প্রজন্মগত ফাটল স্পষ্ট হচ্ছে। একদিকে আছে বেকার ও হতাশ তরুণরা, অন্যদিকে ঝুঁকি এড়ানো ও ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত বয়স্করা। এটি সামাজিক সংহতি দুর্বল করতে এবং পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতি বাড়াতে পারে।
অর্থনৈতিক প্রভাবের কথা উল্লেখ করে সাইমন বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদি অশান্তি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষুণ্ন, বাণিজ্য ও পর্যটন ব্যাহত এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ উন্নয়ন থেকে নিরাপত্তা খাতে সরিয়ে দেয়। সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্নের কারণে রপ্তানি ধীর হতে পারে, নতুন চাকরি সৃষ্টিতে বাধা আসে, ফলে তরুণ বেকারত্ব বাড়ে। এরই মধ্যে দুর্বল অর্থনীতিতে এমন আন্দোলন ও অস্থিতিশীলতার চক্র ঋণ, মূল্যস্ফীতি ও মূলধন প্রস্থানের সমস্যা বাড়িয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি সীমিত করে।’
একই সময়ে এ অশান্তি পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য সুযোগও তৈরি করে বলে মনে করেন সাইমন। তিনি বলেন, ‘পশ্চিমারা সহায়তা, নীতি শর্তাবলি বা নরম শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রশাসন ও অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে। তারা প্রায়ই গণতান্ত্রিক যুব আন্দোলনের আড়ালে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ এগিয়ে নিয়ে যায়।’
তবে এ পরিস্থিতিকে নতুন সুযোগ হিসেবে দেখতে চান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওবায়দুল হক। তিনি বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশে ‘জেনারেশন জেড’ তরুণদের নেতৃত্বে আন্দোলনগুলো রাষ্ট্রের অচলায়তন ভাঙার নতুন ধারা তৈরি করেছে। এ ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়। মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে থাকা চাপা ক্ষোভ এতে প্রকাশ পেয়েছে। তরুণরা অচলায়তন ভাঙতে চাইছেন, যার প্রভাব সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে পড়ছে।
তরুণদের এ সাহসের পেছনের কারণ হিসেবে ওবায়দুল বলেন, পশ্চিমারা নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার (রুলস বেসড ইন্টারন্যাশনাল অর্ডার) কথা বলে। কিন্তু ফিলিস্তিন বা গাজার মতো ঘটনার ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান মানুষের আস্থা হ্রাস করছে। তরুণরা দেখেছেন, বিদ্যমান অচলায়তন ভাঙা সম্ভব আর এতে তাদের মধ্যে নতুন সাহস ও উদ্যোগ তৈরি হয়েছে। এটি ধ্বংসাত্মক নয়, বরং একটি প্রক্রিয়ার অংশ, যা সমাজকে নতুনভাবে গড়ার পথ দেখায়।
আন্দোলনের কারণে সৃষ্ট অস্থিরতাই শুধু অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন না ঢাবির এ শিক্ষক। তিনি বলেন, বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং জলবায়ুর পরিবর্তনও প্রভাব ফেলছে। উদাহরণস্বরূপ, বর্ষাকালের ধরনের পরিবর্তন সরাসরি কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে। এছাড়া স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ বা এলডিসি গ্রাজুয়েশন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংক্রান্ত নীতি পরিবর্তনও অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে।
এ অস্থিরতা ইতিবাচকও হতে পারে বলে মনে করেন ওবায়দুল। তিনি বলেন, এটি নতুন সুযোগের জন্ম দিচ্ছে। তবে আমরা কতটা প্রস্তুত এবং সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারছি কি না তা গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসায়িক ও নীতি-নির্ধারণের স্তরে প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অচলায়তনের এ পর্যায়কে আমরা একটি ট্রানজিশন ফেজ (রূপান্তরের পর্যায়) হিসেবে দেখতে পারি, যেখানে নতুন বাস্তবতা এবং নতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
ওবায়দুলের পরামর্শ- ধৈর্য ধরতে হবে। বর্তমান অবস্থা ভবিষ্যতে দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করার সম্ভাবনা রাখে।
আন্দোলনের নেপথ্যে:
শ্রীলঙ্কায় আন্দোলনের পেছনের কারণ ছিল অর্থনৈতিক বিপর্যয়। ২০২২ সালের মার্চে দেশটিকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়। দৈনন্দিন জীবন কঠিন হয়ে যায়। দীর্ঘ লোডশেডিং, জ্বালানি ও গ্যাসের জন্য দীর্ঘ লাইন এবং মুদ্রাস্ফীতি ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ফলে কলম্বোয় রাষ্ট্রপতির সচিবালয় ও রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ি, এমনকি প্রধান গণমাধ্যমের কার্যালয়েও হামলা হয়।
বাংলাদেশে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান মূলত সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটার বিরুদ্ধে শুরু হয়। তবে পুলিশি দমন, ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগে বাধা দেওয়া এবং নিহত হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লে আন্দোলন রাজনৈতিক অস্থিরতার দিকে গড়ায়। সহস্রাধিক মানুষ নিহত হওয়ার পর অবশেষে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। পরে তিনি ভারতে আশ্রয় নেন।
নেপালে সাম্প্রতিক জেনারেশন জেড বা জেন জি নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল সরকারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে। যদিও সরকার বলেছিল প্ল্যাটফর্মগুলো অপব্যবহার হচ্ছে। আর আন্দোলনকারীদের মূল ক্ষোভের কারণ ছিল বৈষম্য, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। হাজার হাজার কিশোর-কিশোরী স্কুলের পোশাকেই রাস্তায় নেমে আসে। কয়েক দিনের সংঘর্ষে ৭০ জনের বেশি নিহত ও শত শত আহত হন। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগে পরিস্থিতি শিথিল হয়।
প্রকাশক ও সম্পাদক : মো. জাকির হোসেন
dailyalokitochandpur@gmail.com, +8801613090707
Copyright © 2025 Dailyalokitochandpur. All rights reserved.