ছাত্রজনতার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর হতে চলছে। এই অভ্যুত্থানের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং তার প্রতিফলন নিয়ে প্রশ্ন আছে অসংখ্য। অনেকে এক বছরে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ না হওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়েছেন। আবার কেউবা যতটুকু পূরণ হয়েছে তা এবং পরে আরও ভালো করার প্রত্যয় নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চেয়েছেন।
তবে গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে উভয়পক্ষই হয়ে পড়েছেন বেশ স্মৃতিকাতর। এক বছর আগের জুলাই মাসে কোনদিন কী ঘটেছিল, সেসবের স্মৃতি রোমন্থন করে ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনা জাগ্রত রাখতে বদ্ধপরিকর সবাই। সবারই এক কথা, জুলাইকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তাই তো গণঅভ্যুত্থানের সহায়ক যেসব বিষয় ছিল, সেসব নিয়েও চলছে চুলচেড়া বিশ্লেষণ।
গণঅভ্যুত্থানে যেসব শক্তি সবচেয়ে বেশি সহায়ক হিসেবে কাজ করেছিল তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিতে আন্দোলন। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সাড়ে ১৫ বছরেও শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে না পারলেও শিক্ষার্থীরা তা মাত্র ৩৬ দিনেই সম্ভব করেছিলেন। এক্ষেত্রে সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন- এমনটিই মনে করেন ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতা ও অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা।
কেননা তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সর্বত্র ছিল আওয়ামী লীগপন্থি শিক্ষকদের একক আধিপত্য। তারা কোনোভাবেই এমন একটি আন্দোলন সফল হতে দিতে চাইতেন না এবং ২০১৮ সালের মতো বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে আন্দোলন দমাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাইয়ে তারা নিজেরাই আন্দোলনে থাকায় সেটি তো করতে পারেননি বরং ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে পরোক্ষভাবে সহায়তা করেন।
২০২৩ সালে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন-২০২৩ প্রণয়ন করা হয়। পরের বছর ২০২৪ সালের ১৩ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। সেখানে বলা হয়, ২০২৪ সালের ১ জুলাইয়ের পর থেকে স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার চাকরিতে যারা নতুন যোগ দেবেন, তারা বিদ্যমান ব্যবস্থার মতো আর অবসরোত্তর পেনশন সুবিধা পাবেন না। তার পরিবর্তে নতুনদের বাধ্যতামূলক সর্বজনীন পেনশনের আওতাভুক্ত করা হবে।
সরকারের এ সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়ে ২০২৪ সালের মার্চ থেকেই বিবৃতি, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন ছোট ছোট কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষকরা। এর সঙ্গে দ্রুতই যুক্ত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তারা এ স্কিমকে বৈষম্যমূলক উল্লেখ করে অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানিয়ে আন্দোলন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, কর্মচারী ঐক্য পরিষদসহ সারাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং কর্মচারীরা ঈদের পরে বেশ কয়েকদিন অর্ধদিবস কর্মবিরতি এবং পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালন করেন। তবে এ সময়ে পরীক্ষা ও জরুরি সেবা এর আওতামুক্ত ছিল। ১ জুলাই থেকে তারা সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে যান। কর্মসূচি অনুযায়ী ১ জুলাই থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের সব ক্লাস, অনলাইন-সান্ধ্যকালীন ক্লাস ও শুক্র-শনিবারের প্রফেশনাল কোর্সের ক্লাস, সব পরীক্ষা, বিভাগীয় অফিস-সেমিনার-কম্পিউটার ল্যাব ও গবেষণাগার, একাডেমিক কমিটি-সমন্বয় ও উন্নয়ন কমিটি এবং প্রশ্নপত্র সমন্বয় সভা, অনুষদের ডিন কার্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাসহ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম, নবীনবরণ অনুষ্ঠানের কর্মসূচি গ্রহণ, বাছাই বোর্ডের সভা, বিভিন্ন ইনস্টিটিউটের কার্যালয়, ক্লাস ও পরীক্ষা, সান্ধ্যকালীন, শুক্র ও শনিবারের ক্লাস, বিভিন্ন গবেষণা কেন্দ্রের সেমিনার, কনফারেন্স ও ওয়ার্কশপের কর্মসূচি, বিভিন্ন হলের প্রাধ্যক্ষ কর্যালয় এবং কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার বন্ধ রাখা হয়।
এদিকে একইদিন থেকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনও ভিন্ন মাত্রা লাভ করে। ক্লাস-পরীক্ষা এবং লাইব্রেরি বন্ধ থাকায় এ আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদিয়া আফরোজ বলেন, ‘ক্লাস-পরীক্ষা চালু থাকলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই আন্দোলনে অংশ নিতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকতেন। কিন্তু শিক্ষকদের পক্ষ থেকেই ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করায় সেই বিষয়টি ছিল না।’
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেই বিষয়টি, সেটি হলো নীল দল তথা সরকারপন্থি শিক্ষকদের আস্ফালন দেখানোর সুযোগ এই আন্দোলনের মাধ্যমে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ২০১৮ সালে যেমন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা ক্লাসে না এলে ফেল করিয়ে দেওয়া, আন্দোলনে অংশ নিলে পরীক্ষায় বসতে না দেওয়াসহ নানান হুমকি দেওয়া হতো। ২০২৪ সালে সেটি সম্ভব হয়নি।
এমন অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা ও বর্তমানে ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, আমরা ২০১৮ সালের ৮ এপ্রিলের পরে তৎকালীন ভিসি আখতারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি আমাদের বলেছিলেন, তোমরা আন্দোলন বন্ধ করো না হলে তোমাদের সার্টিফিকেট বাতিল করা হবে। নীল দলের শিক্ষকরা হুমকি দিতেন, পরীক্ষায় বসতে দেবেন না। আবার অনেক সময় শেখ হাসিনার কাছে নিয়ে যাবে, কী কী দরকার সব ম্যানেজ করে দেবে এমন লোভও দেখিয়েছিল। সেসময় আসলে সরাসরি অনেক কোর্স টিচারের হুমকি উপেক্ষা করেই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে আসতে হয়েছে।
মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ইয়ালিদ নাঈম বলেন, ২০১৮ সালে আমাদের শিক্ষকরা এভাবে বলে দিতেন, আমি ক্লাস নেব। তোমরা আসলে আসবা, না আসলে নাই। না আসলে অ্যাটেনডেন্স দেওয়া হবে না। অ্যাটেনডেন্স না থাকলে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হবে না। আমরা সেসব হুমকির তোয়াক্কা না করেই যেতাম। ২০২৪ সালে সেই বিষয়টি ছিল না। পরোক্ষভাবে তবু কিছু হুমকি এসেছিল, তবে শিক্ষকদের দাবি না মানায় তাদেরও এক ধরনের চাপা ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল।
শিক্ষক-কর্মচারীদের আন্দোলন ১ জুলাই থেকে সর্বাত্মক আন্দোলনে রূপ নিলে সেদিন থেকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনও সর্বাত্মক রূপ নিতে শুরু করে। পরে শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে শিক্ষকদের আন্দোলনের তীব্রতা হারিয়ে যায়। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আশ্বাস না পাওয়ায় তারা কর্মসূচি চালিয়ে যেতে থাকেন। পরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে সরকার পতনের দিকে এগোলে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোনো পূর্বঘোষণা না দিয়েই আন্দোলন স্থগিত করেন। ক্ষমতা হারানোর দুদিন আগে ৩ আগস্ট প্রত্যয় স্কিম বাতিল করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রকাশক ও সম্পাদক : মো. জাকির হোসেন
dailyalokitochandpur@gmail.com, +8801613090707
Copyright © 2025 Dailyalokitochandpur. All rights reserved.